|
রবি, ১৩ নভেম্বর ২০১১, ২৯ কার্তিক ১৪১৮
লেখক: সঞ্জয় চাকী
সিনিয়র স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, চ্যানেল আই
কংগোর মত আফ্রিকার দেশগুলোতে আমের কোনো বিশেষ মৌসুম নেই । সারা বছরই আম
হয়। একবার পেকে শেষ না হতেই আবার নতুন মুকুল আসে। তবে এই যে এত আম .. এত
খাদ্যের অভাব.. তারপরও আম নাকি সেভাবে খায় না এরা। নীচে পড়ে নষ্ট হয়। কেন
খায় না তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এই গল্প শুনে সবাই হাসাহাসি করি..
বাংলাদেশের ‘প্রাণ’ যদি এই আম পেত তাহলে জুস আর আচার বানিয়ে সারা পৃথিবীতে
ছড়িয়ে দিত। গল্প করতে করতে রাস্তার দুরাবস্থায় সবাই চিন্তিত। সড়কপথে কেউই
ফিরতে রাজি হলেন না বুনিয়া। বিকল্প ব্যবস্থা হল হেলিকপ্টারে ফেরার। তবে
হেলিকপ্টার মিলবে মঙ্গলবার। আরো ক’দিন দেরী। এ কারণে কংগো আর উগান্ডার
প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ানোর সুযোগ বেড়ে গেল। কংগোতে আসার আগেই চ্যানেল আই
সংবাদের প্রধান ও পরিচালক শাইখ সিরাজ বলেছিলেন, আফ্রিকায় যাচ্ছ .. ওখানে
বাংলাদেশের কৃষির সম্ভাবনা কেমন সেটা দেখে এসো। এবার যেন সেই সুযোগটা পেয়ে
গেলাম।
ওখান থেকেই একদিন উগান্ডা বেড়াতে গেলাম। জাতিসংঘের পরিচয়পত্র থাকায়
কংগো থেকে একদিনের জন্য উগান্ডা যেতে ভিসার দরকার হল না। সড়ক পথেই গেলাম
উগান্ডার ন্যাশনাল সাফারি পার্ক আর মারসিসন জলপ্রপাত দেখতে। কংগোর মত খারাপ
রাস্তা দেখিনি উগান্ডায়। ঝকঝকে চকচকে রাস্তা। মাইলের পর মাইল বিশাল ফাঁকা
প্রান্তর। হালকা আগাছা দিয়ে সবুজ প্রকৃতি। মালভূমির মত। একেবারে সমতলও আছে
অনেক জায়গায়। যতদূর দৃষ্টি যায় একরকমই দৃশ্য। হঠাত্ দু’চারটা বাড়িঘর।
ছোট-খাট বাজার। লোকালয়ের পাশে কিছু চাষবাস। সবজি বাগান। বাদবাকি হাজার
হাজার একর জমিতে কোনো চাষাবাদ নেই। চাষাবাদ করার লোকও নেই। উগান্ডার সাফারি
পার্কে প্রবেশের পর টানা দু’ঘণ্টা কমপক্ষে ৮০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলেছে।
দু’পাশে কোনো মানুষ চোখে পড়েনি। বাড়ি-ঘর তো নেইই। মাঝে জিরাফ, হরিণ, মহিষ,
গরুসহ বিভিন্ন পশুপাখি দেখেছি। অবাক হয়েছিলাম এত বড় ফাঁকা জায়গা দেখে।
আমাদের টিম লিডার ব্যানব্যাট ২/১০ -এর কমান্ডার কর্নেল কবির বললেন,
পশুপাখির জন্য এত জায়গা না রেখে কি করবে? মানুষের জন্য তো এত জায়গার দরকার
নেই। সাফারি পার্কের বাইরেও এরকম জায়গা তো এমনিই পড়ে থাকে এখানে। আমাদের
দেশের মত না। চলতে চলতে সেনা সদরের সিভিল কর্মকর্তা হুমায়ুন শরীফ বলছিলেন,
আমাদের অনেক মানুষ আছে জায়গা নেই। এখানে ঠিক তার উল্টো। তাই মাইলের পর মাইল
এরকম অনাবাদি জমি। আর এই ঘুরতে গিয়ে দেখলাম আমের মত তাল, কাঁঠালসহ আমাদের
পরিচিত কিছু ফলও আছে। তবে এসব খাওয়ার লোক নেই। গাছেই নষ্ট হয়। লাখ লাখ তাল
গাছ। কেউ মনে হয় ছুঁয়েও দেখে না। আর কাউকে ‘তালের মত কালো’ বলার সুযোগ নেই
অফ্রিকায়। কালো মানুষের এই দেশে তালের রঙ হলদে। আর কাকের গলায় দেখেছি সাদা
দাগ। সাদা কাকও আছে আফ্রিকায়।
আসা-যাওয়ার পথে দু’দেশেই চোখে পড়ে কলাগাছ আর অসংখ্য কফি বাগান। প্রায় প্রতিটা বাড়ির পাশেই কফি গাছ আছে। কর্নেল কবির জানালেন,
কফি চাষ থাকলেও কংগোতে কফি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে ওঠেনি আজও। কফির মত
চাবাগানও ব্যাপকহারে হতে পারে এখানে। সিলেটের চা বাগানের অভিজ্ঞতা নিয়ে
এখানে হতে পারে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পও। মাঝে মাঝেই দেখেছি ডোবা বা
পুকুরের মত। পানিও আছে। পথে নদীও পার হলাম। কৃষি শিল্প নিয়ে কথা বলতে গিয়ে
কর্নেল কবির বলছিলেন, এখানে যে ধান হবে না তা নয়। মাটির যে অবস্থা তাতে
ঠিকমত সেচ দিলে ধান না হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে সবজি খুবই ভাল হয়।
বুনিয়াতে মেজর তৌহিদ বলেছিলেন, এখানে উপত্যকা বা মালভূমির মত পাহাড়ের মাঝে
মাঝেও ছোট ছোট নদী ও ঝরনা আছে। তাতে বাঁধ দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করা যেতে
পারে। পাহাড়প্রধান দেশগুলো যেভাবে সেচের ব্যবস্থা করে।
কংগোর মাহাগীর টেরিটরি কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয় আমাদের।
সেখানে কথা হয় কৃষি আর বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। তিনি জানান,
কংগো সরকার এবং এখানকার জনগণ খুবই আগ্রহী বাংলাদেশের মাধ্যমে কৃষি
সম্প্রসারণ নিয়ে। তবে এজন্য রাজধানী কিংসাসা গিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনা
হওয়া দরকার।
মাহাগী থেকে বুনিয়া। সেখানে কংগোর কাজ শেষ করে আবার বুনিয়া থেকে এনটিবি
এয়ারপোর্ট হয়ে উগান্ডা। উগান্ডার এনটিবিতে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে বাংলা হাউজে
উগান্ডা প্রবাসী বাংলাদেশীদের নিয়ে মতবিনিময়। সেখানেই আরো কথা হয় কংগো,
উগান্ডা বা আফ্রিকায় বাংলাদেশের কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিয়ে।
৩০ বছর ধরে উগান্ডার রাজধানী কামপালায় আছেন খাইরুল ইসলাম। একসময় জাতিসংঘের
একটি প্রকল্পে চাকরি করতেন। স্বপরিবারে রয়ে গেছেন এখানেই। স্বাধীন ব্যবসা
করেন। তিনি বলছিলেন, উগান্ডা সরকার বেশ কয়েকটি দেশকে চিহ্নিত করেছে যেসব
দেশের মাধ্যমে কৃষি খাতের উন্নয়ন ঘটাতে পারবে উগান্ডা। এরমধ্যে বাংলাদেশ
অন্যতম। কৃষি খাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগকে গুরুত্ব দিতে
চায় উগান্ডা। তিনি মনে করেন, উগান্ডায় বাংলাদেশের কৃষি উত্পাদন ও
কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। তবে এখানে সরকারি জমি
নেই। জমি সাধারণ মানুষের। জমির দামও সস্তা। একশ’ ডলারে কয়েক একর জমি মিলতে
পারে। তবে বিদেশিরা সরাসরি জমি কিনতে পারে না। পারে লিজ নিতে। ৯৯ বছরের
লিজও পাওয়া যেতে পারে আলোচনার মাধ্যমে। তবে জমি কেনাও অসম্ভব নয়। জমি কিনতে
হলে স্থানীয়দের সঙ্গে যৌথ মালিকানার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে জমি কিনতে
হবে। আর লাভের টাকা দেশে আনাও সম্ভব। এক্ষেত্রে স্থানীয় শ্রমিকদের
প্রাধান্য দিতে হবে। এসময় আরো কথা হয় আবুল কাশেম মজুমদারের সঙ্গে। তিনি
বাংলাদেশের এনজিও ব্র্যাকের উগান্ডার প্রধান। তিনি জানান, গত বছর থেকে
ব্র্যাক উগান্ডায় বিভিন্ন ধরনের কৃষিবীজ উত্পাদন শুরু করেছে। দিন দিন
কৃষিভিত্তিক কার্যক্রম বাড়ছে। বাংলাদেশের ৭২ জন কর্মী ব্র্যাকের হয়ে কাজ
করছে উগান্ডায়। আবুল কাশেম মজুমদারও মনে করেন, সেখানে বাংলাদেশের
কৃষিভিত্তিক শিল্প বা কৃষি উত্পাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তবে সেখান থেকে
উত্পাদন করে বাংলাদেশে আনার চেষ্টা লাভজনক হবে না। আফ্রাির দেশে উত্পাদন
করে সেদেশেই বা আশপাশের দেশ কিংবা ইউরোপের দেশগুলোতে রফতানি লাভজনক হবে।
মতবিনিময় অন্য যারা ছিলেন তাদের অনেকেই মনে করেন, এসব দেশে বাংলাদেশের
গামেন্টর্স সামগ্রী ও ওষুধের ব্যবসার ভাল সম্ভাবনা আছে। প্রশ্ন উঠেছিল এসব
দেশে নিরাপত্তা আর এইডস, ম্যালেরিয়া বা রোগ-বালাইয়ের ভয় নিয়ে। এসব শুনে
অনেকেই বলেছেন, আমরা তো এখানে আছি। সচেতন থাকতে হবে, তাহলেই ভাল থাকা যাবে।
http://new.ittefaq.com.bd/news/view/54835/2011-11-13/29
|